গ্লাইকোলাইসিস (Glycolysis)

গ্লাইকোলাইসিস হল একটি প্রাচীন এবং সর্বব্যাপী মেটাবলিক Pathway (বিপাকীয় পথ) যেখানে একটি গ্লুকোজ অণু (৬-কার্বন বিশিষ্ট) ভেঙে দুটি পাইরুভেট অণু (৩-কার্বন বিশিষ্ট) তৈরি হয়। এটি বায়বীয় এবং অবায়বীয় উভয় শ্বসন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ। গ্লাইকোলাইসিস শব্দটির উদ্ভব গ্রিক শব্দ থেকে – Glykys অর্থ “মিষ্টি” এবং Lysis অর্থ “ভাঙ্গন”।

এই প্রক্রিয়াটি সাইটোপ্লাজমে সংঘটিত হয় এবং এটি অক্সিজেনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি নির্বিশেষে ঘটতে পারে।

গ্লাইকোলাইসিসের প্রধান দিকসমূহ (Key Features):

  1. সর্বত্রতা: প্রায় সকল জীবের দেহে (প্রোক্যারিওট এবং ইউক্যারিওট উভয় ক্ষেত্রে) এই প্রক্রিয়া ঘটে।
  2. অক্সিজেন-স্বাধীনতা: এটি অক্সিজেনের প্রয়োজন ছাড়াই ঘটে।
  3. শক্তি উৎপাদন: একটি গ্লুকোজ অণু থেকে নিট ২টি ATP এবং ২টি NADH অণু উৎপন্ন হয়।
  4. পাইরুভেটের ভাগ্য: প্রক্রিয়ার শেষে উৎপন্ন পাইরুভেটের ভাগ্য পরিবেশের অক্সিজেনের উপস্থিতির উপর নির্ভরশীল।
    • অক্সিজেনের উপস্থিতিতে: পাইরুভেট মাইটোকন্ড্রিয়ায় প্রবেশ করে ক্রেবস চক্র ও ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইনের মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে জারিত হয়।
    • অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে: পাইরুভেট Lactate (ল্যাকটেট) বা Ethanol (ইথানলে) পরিণত হয়, যাকে anaerobic respiration (অবাত শ্বসন) বা fermentation (গাঁজন) বলে।

গ্লাইকোলাইসিসের ধাপসমূহ :

গ্লাইকোলাইসিসকে দুটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করা যায় :

  1. শক্তি বিনিয়োগ পর্যায় (Energy Investment Phase): ধাপ ১-৫। এই পর্যায়ে ২টি ATP খরচ হয়।
  2. শক্তি লাভ পর্যায় (Energy Payoff Phase): ধাপ ৬-১০। এই পর্যায়ে ৪টি ATP এবং ২টি NADH উৎপন্ন হয়।

পর্যায় ১: শক্তি বিনিয়োগ পর্যায়

  1. ধাপ ১: ফসফোরিলেশন (Phosphorylation)
    • এনজাইম: হেক্সোকিনেজ (Hexokinase)
    • প্রতিক্রিয়া: একটি ATP অণু থেকে একটি ফসফেট গ্রুপ (-PO₄) গ্লুকোজ অণুর ৬নং কার্বনে যুক্ত হয়ে গ্লুকোজ-৬-ফসফেট তৈরি হয়। এটি গ্লুকোজকে ট্র্যাপ করে রাখে, কারণ চার্জযুক্ত এই অণুটি কোষ পর্দা ভেদ করে বের হতে পারে না।
  2. ধাপ ২: আইসোমেরাইজেশন (Isomerization)
    • এনজাইম: ফসফোগ্লুকোজ আইসোমারেজ (Phosphoglucose Isomerase)
    • প্রতিক্রিয়া: গ্লুকোজ-৬-ফসফেট (এলডিহাইড) তার আইসোমার ফ্রুক্টোজ-৬-ফসফেট (কিটোন)-এ পরিণত হয়। পরবর্তী ধাপে আরেকটি ফসফেট গ্রুপ যুক্ত হওয়ার জন্য এই রূপান্তর প্রয়োজন।
  3. ধাপ ৩: ফসফোরিলেশন (Phosphorylation)
    • এনজাইম: ফসফোফ্রুক্টোকিনেজ-১ (Phosphofructokinase-1 – PFK-1)
    • প্রতিক্রিয়া: আরেকটি ATP অণু থেকে একটি ফসফেট গ্রুপ ফ্রুক্টোজ-৬-ফসফেটের ১নং কার্বনে যুক্ত হয়ে ফ্রুক্টোজ-১,৬-বিসফসফেট তৈরি হয়। এই ধাপটি গ্লাইকোলাইসিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বিন্দু (rate-limiting step)
  4. ধাপ ৪: বিভাজন (Cleavage)
    • এনজাইম: অ্যালডোলেজ (Aldolase)
    • প্রতিক্রিয়া: ৬-কার্বন বিশিষ্ট ফ্রুক্টোজ-১,৬-বিসফসফেট ভেঙে ৩-কার্বন বিশিষ্ট দুটি ভিন্ন আইসোমারিক শর্করা তৈরি হয়: ডাইহাইড্রোক্সি অ্যাসিটোন ফসফেট (DHAP) এবং গ্লিসার্যালডিহাইড-৩-ফসফেট (G3P)
  5. ধাপ ৫: আইসোমেরাইজেশন (Isomerization)
    • এনজাইম: ট্রায়োজ ফসফেট আইসোমারেজ (Triose Phosphate Isomerase)
    • প্রতিক্রিয়া: DHAP, G3P-তে রূপান্তরিত হয়। এক্ষেত্রে একটি গ্লুকোজ অণু থেকে দুইটি G3P অণু তৈরি হয়েছে। পরবর্তী সকল ধাপ প্রতিটি G3P অণুর জন্য দুইবার ঘটবে।

পর্যায় ২: শক্তি লাভ পর্যায়

  1. ধাপ ৬: জারণ ও ফসফোরিলেশন (Oxidation and Phosphorylation)
    • এনজাইম: গ্লিসার্যালডিহাইড-৩-ফসফেট ডিহাইড্রোজেনেজ (Glyceraldehyde-3-phosphate Dehydrogenase – GAPDH)
    • প্রতিক্রিয়া: প্রতিটি G3P জারিত হয় এবং একটি অজৈব ফসফেট (Pi) যুক্ত হয়ে ১,৩-বিসফসফোগ্লিসারেট তৈরি হয়। এই জারণ বিক্রিয়ায়, দুইটি ইলেকট্রন এবং ১টি প্রোটন NAD+ গ্রহণ করে NADH + H⁺-এ পরিণত হয়। (মোট ২টি NADH তৈরি হয়)।
  2. ধাপ ৭: ATP উৎপাদন (Substrate-Level Phosphorylation)
    • এনজাইম: ফসফোগ্লিসারেট কিনেজ (Phosphoglycerate Kinase)
    • প্রতিক্রিয়া: ১,৩-বিসফসফোগ্লিসারেটের একটি ফসফেট গ্রুপ ADP-তে স্থানান্তরিত হয়ে ATP তৈরি করে এবং ৩-ফসফোগ্লিসারেট অণু তৈরি হয়। যেহেতু দুটি G3P ছিল, তাই ২টি ATP উৎপন্ন হয়।
  3. ধাপ ৮: পুনর্বিন্যাস (Rearrangement)
    • এনজাইম: ফসফোগ্লিসারেট মিউটেজ (Phosphoglycerate Mutase)
    • প্রতিক্রিয়া: ৩-ফসফোগ্লিসারেট অণুর ফসফেট গ্রুপ ৩নং কার্বন থেকে ২নং কার্বনে স্থানান্তরিত হয়ে ২-ফসফোগ্লিসারেট তৈরি হয়।
  4. ধাপ ৯: ডিহাইড্রেশন (Dehydration)
    • এনজাইম: এনোলেজ (Enolase)
    • প্রতিক্রিয়া: ২-ফসফোগ্লিসারেট থেকে একটি পানি অণু (H₂O) অপসারিত হয়ে ফসফোইনোল পাইরুভেট (PEP) তৈরি হয়। এই বিক্রিয়ায় অণুটিতে প্রচুর পরিমানে শক্তি সঞ্চিত হয়।
  5. ধাপ ১০: ATP উৎপাদন (Substrate-Level Phosphorylation)
    • এনজাইম: পাইরুভেট কিনেজ (Pyruvate Kinase)
    • প্রতিক্রিয়া: PEP-এর ফসফেট গ্রুপটি ADP-তে স্থানান্তরিত হয়ে ATP এবং পাইরুভেট অণু তৈরি করে। যেহেতু দুটি PEP ছিল, তাই আরও ২টি ATP উৎপন্ন হয়।

শক্তির হিসাব (Energy Calculation):

  • মোট ATP খরচ: ২টি (ধাপ ১ এবং ৩)
  • মোট ATP উৎপন্ন: ৪টি (ধাপ ৭ থেকে ২টি এবং ধাপ ১০ থেকে ২টি)
  • নিট ATP লাভ: ৪ – ২ = ২টি ATP
  • মোট NADH উৎপন্ন: ২টি (ধাপ ৬)

সুতরাং, একটি গ্লুকোজ অণু থেকে গ্লাইকোলাইসিসে নিট ২টি ATP, ২টি NADH এবং ২টি পাইরুভেট অণু উৎপন্ন হয়।

গ্লাইকোলাইসিসের নিয়ন্ত্রণ (Regulation of Glycolysis)

গ্লাইকোলাইসিসের গতি তিনটি এনজাইম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যেগুলো অপরিবর্তনীয় ধাপ অনুঘটক করে:

  1. হেক্সোকিনেজ: গ্লুকোজ-৬-ফসফেট দ্বারা নিষেধিত (inhibited) হয়। (উৎপাদন বেশি হলে Feedback inhibition)।
  2. ফসফোফ্রুক্টোকিনেজ-১ (PFK-1): এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক এনজাইম
    • বাধাদানকারী (Inhibitors): ATP, সাইট্রেট (উচ্চ শক্তি স্তর নির্দেশ করে)।
    • উদ্দীপক (Activators): AMP, ADP (নিম্ন শক্তি স্তর নির্দেশ করে), ফ্রুক্টোজ-2,6-বিসফসফেট (Fructose-2,6-bisphosphate – PFK-1-এর সবচেয়ে শক্তিশালী activator)।
  3. পাইরুভেট কিনেজ: ATP এবং অ্যাসিটাইল-CoA দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফ্রুক্টোজ-১,৬-বিসফসফেট দ্বারা উদ্দীপিত হয় (Feed-forward activation)।

গ্লাইকোলাইসিসের গুরুত্ব (Significance):

  1. দ্রুত শক্তি উৎপাদন: অক্সিজেন ছাড়াই অল্প সময়ের মধ্যে ATP উৎপাদন করতে পারে, যা পেশী সংকোচনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  2. বিভিন্ন বিপাকীয় পথের সাথে সংযোগ: গ্লাইকোলাইসিসের মধ্যবর্তী যৌগগুলি অন্যান্য অনেক বিপাকীয় পথের জন্য Precursor (পূর্বসূরী) হিসেবে কাজ করে, যেমন:
    • পেন্টোজ ফসফেট পথ
    • গ্লুকোজজেনেসিস (গ্লুকোজ সংশ্লেষণ)
    • গ্লাইকোজেন সংশ্লেষণ
    • ফ্যাটি অ্যাসিড সংশ্লেষণ
  3. অবাত শ্বসনের ভিত্তি: যে পরিবেশে অক্সিজেন নেই (যেমন: মাটিতে, কিছু অনুজীবে, এবং strenous ব্যায়ামের সময় পেশী কোষে), সেখানে গ্লাইকোলাইসিসই ATP উৎপাদনের একমাত্র উৎস।

10 thoughts on “গ্লাইকোলাইসিস (Glycolysis)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *